jobedubd3415 Avatar

Hayatus Sahabah (Ra.)

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কর্তৃক তাঁহার মৃত্যুশয্যায় হযরত উসামা (রাঃ)
(এর বাহিনী) কে প্রেরণের প্রতি গুরুত্ব প্রদান এবং হযরত
আবু বকর (রাঃ) কর্তৃক তাঁহার খেলাফত লাভের
পর সর্বপ্রথম উক্ত বাহিনী প্রেরণের
প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান।

 

হযরত উসামা ইবনে যায়েদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাহাকে (ফিলিস্তীনের) উবনা এলাকার উপর ভোরে ভোরে আক্রমণ করিয়া তাহাদের ঘরবাড়ী জ্বালাইয়া দিবার আদেশ দিলেন এবং বলিলেন, আল্লাহর নাম লইয়া রওয়ানা হইয়া যাও। হযরত উসামা (রাঃ) (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেওয়া) ঝাণ্ডা লইয়া বাহিরে আসিলেন এবং উক্ত, ঝাণ্ডা হযরত বুরাইদাহ ইবনে হুসাইব আসলামী (রাঃ) এর হাতে দিলেন। তিনি উহা লইয়া হযরত উসামা (রাঃ) এর ঘরে আসিলেন। হযরত উসামা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশক্রমে জুরুফ নামক স্থানে ছাউনী স্থাপন করিলেন, যাহা বর্তমানে সেকায়া সুলাইমান নামে পরিচিত। তিনি আপন বাহিনীকে উক্ত স্থানে সমবেত করিলেন। লোকেরা নিজ নিজ প্রস্তুতি গ্রহণ শেষে জুরুফে আসিয়া অবস্থান গ্রহণ করিতে লাগিল। যাহার প্রস্তুতি শেষ হয় নাই সে তাহার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত রহিল।

মুহাজিরীনে আউয়ালীন অর্থাৎ সর্বপ্রথম হিজরতকারী মুহাজিরগণ সকলেই এই যুদ্ধে শরীক হইয়াছিলেন। হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব, হযরত আবু ওবায়দাহ, হযরত সা’দ ইবনে আবি ওক্কাস, হযরত আবুল আওয়ার, সাঈদ ইবনে যায়েদ, ইবনে আমর ইবনে নুফায়েল (রাঃ) সহ অন্যান্য মুহাজির ও আনসারগণও এই বাহিনীতে শামিল ছিলেন। আনসারদের মধ্য হইতে হযরত কাতাদাহ ইবনে নোমান, হযরত সালামা ইবনে আসলাম ইবনে হারীশ (রাঃ) ও শরীক ছিলেন। হযরত উসামা ইবনে যায়েদ (রাঃ) কে আমীর নিযুক্ত করার ব্যাপারে কতিপয় মুহাজিরীন আপত্তি করিলেন এবং এই ব্যাপারে হযরত আইয়াশ ইবনে আবি রাবিয়াহ (রাঃ) সর্বাপেক্ষা শক্ত কথা বলিলেন। তিনি বলিলেন, প্ৰথম শ্রেণীর মুহাজিরীনদের উপর এই বালককে আমীর নিযুক্ত করা হইতেছে ? অতঃপর ইহা লইয়া লোকদের মধ্যে বেশ আলোচনা চলিতে লাগিল । হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) এক ব্যক্তিকে এরূপ কিছু কথা বলিতে শুনিয়া তাহার বিরোধিতা করিলেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আসিয়া তাঁহাকে এই ব্যাপারে অবহিত করিলেন। শুনিয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত নারাজ হইলেন। (অসুস্থতার দরুন) তিনি মাথায় পট্টি বাঁধিয়া রাখিয়াছিলেন এবং পরিধানে একখানা চাদর ছিল। (এমতাবস্থায় ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিলেন।) তারপর মিম্বারে উঠিয়া আল্লাহ তায়ালার হামদ ও সানা পাঠ করিয়া বলিলেন—

আম্মা বা’দ, হে লোকসকল, আমি উসামাকে আমীর নিযুক্ত করিয়াছি বলিয়া তোমাদের কিছু লোকের পক্ষ হইতে এ কেমন (সমালোচনামূলক) উক্তি আমার নিকট পৌঁছিয়াছে? আল্লাহর কসম, আজ তোমরা উসামাকে আমীর নিযুক্ত করার উপর আপত্তি করিতেছ ? ইতিপূর্বে তাহার পিতা (হযরত যায়েদ ইবনে হারেসা (রাঃ) কে আমীর নিযুক্ত করার উপরও আপত্তি করিয়াছ। অথচ আল্লাহর কসম, সে আমীর হওয়ার উপযুক্ত ছিল এবং তাহার পর তাহার পুত্র (উসামা) ও আমীর হওয়ার উপযুক্ত। সে যেমন লোকদের মধ্যে আমার নিকট সর্বাধিক প্রিয় ছিল, তেমন তাহার পুত্র উসামাও আমার নিকট সর্বাধিক প্রিয়। ইহারা উভয়েই প্রত্যেক ভালকাজের উপযুক্ত। তোমরা আমার পক্ষ হইতে উসামার সহিত সদ্ব্যবহারের অসিয়ত গ্রহণ কর; কারণ সে তোমাদের মধ্যে পছন্দনীয় ও মনোনীত ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বার হইতে নামিয়া ঘরে প্রবেশ করিলেন। সেদিন রবিউল আউয়ালের দশ তারিখ শনিবার ছিল।

– হযরত উসামা (রাঃ)এর বাহিনীতে যোগদানকারী মুসলমানগণ আসিয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিতে লাগিলেন। তাহাদের মধ্যে হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ)ও ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাহাদের প্রত্যেককে ইহাই বলিতেছিলেন যে, উসামার বাহিনীকে রওয়ানা করিয়া দাও। (হযরত উসামা (রাঃ)এর মাতা) হযরত উম্মে আইমান (রাঃ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আসিয়া আরজ করিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি সুস্থ হওয়া পর্যন্ত উসামাকে তাহার ছাউনি—জুরুফে অবস্থান করিতে বলুন। (এখন তাহাকে রওয়ানা হইতে নিষেধ করুন।) কারণ আপনাকে এই অবস্থায় রাখিয়া রওয়ানা হইয়া গেলে সে (মানসিক স্থিরতার সহিত) কোন কাজ করিতে পারিবে না। (তাহার মন সর্বক্ষণ আপনার সংবাদ জানিবার জন্য উদগ্রীব থাকিবে।) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাহাকেও একই কথা বলিলেন যে, উসামার বাহিনীকে রওয়ানা করিয়া দাও ।

লোকজন সকলেই জুরুফে আসিয়া সমবেত হইল এবং তাহারা রবিবার রাত্র সেখানে কাটাইল। রবিবার দিন হযরত উসামা (রাঃ) (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবস্থা জানার জন্য) মদীনায় আসিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত দুর্বল অজ্ঞান অবস্থায় ছিলেন। এদিনই তাঁহার পরিবারস্থ লোকেরা তাঁহাকে ঔষধ খাওয়াইয়া ছিলেন। হযরত উসামা (রাঃ) যখন তাঁহার খেদমতে হাজির হইলেন তখন তাঁহার চক্ষুদ্বয় হইতে অশ্রু প্রবাহিত হইতেছিল। তাঁহার নিকট হযরত আব্বাস (রাঃ) ও তাঁহার বিবিগণ উপস্থিত ছিলেন। হযরত উসামা (রাঃ) ঝুঁকিয়া তাঁহাকে চুম্বন করিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কথা বলিতে পারিতেছিলেন না। তিনি আপন হস্তদ্বয় উঠাইয়া হযরত উসামা (রাঃ)এর শরীরের উপর রাখিতেছিলেন, হযরত উসামা (রাঃ) বলেন, আমি বুঝিতে পারিলাম যে, তিনি আমার জন্য দোয়া করিতেছেন। আমি সেখান হইতে আমার বাহিনীর অবস্থানস্থলে ফিরিয়া আসিলাম। সোমবার দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছুটা সুস্থবোধ করিলেন। হযরত উসামা (রাঃ) সকালবেলা পুনরায় ছাউনী হইতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে হাজির হইলেন। তিনি তাহাকে বলিলেন, আল্লাহ তায়ালা (তোমার সফরে) বরকত দান করুন, তুমি রওয়ানা হইয়া যাও । হযরত উসামা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট হইতে বিদায় লইলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন সুস্থবোধ করিতেছিলেন। তাঁহার আরাম হওয়ার আনন্দে তাঁহার বিবিগণ একে অপরের চুলে চিরুনী করিতে লাগিলেন। হযরত আবু বকর (রাঃ) খেদমতে হাজির হইয়া আরজ করিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, বিহামদিল্লাহ আজ আপনি সুস্থবোধ করিতেছেন। আজ আমার স্ত্রী বিনতে খারেজার (নিকট অবস্থানের) দিন। আমাকে (তাহার নিকট যাওয়ার) অনুমতি দিন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাহাকে অনুমতি দিলেন। সুতরাং তিনি (মদীনার উঁচু এলাকায় অবস্থিত) সুনাহ মহল্লায় (নিজের ঘরে) চলিয়া গেলেন।

হযরত উসামা (রাঃ) আরোহণ করিয়া নিজ বাহিনীর অবস্থানস্থলে চলিলেন এবং আপন সঙ্গীদের মধ্যে ঘোষণা করিয়া দিলেন যে, সকলে যেন সেখানে পৌঁছিয়া যায়। ছাউনীতে পৌঁছিয়া হযরত উসামা (রাঃ) সওয়ারী হইতে নামিলেন এবং লোকদেরকে রওয়ানা হওয়ার হুকুম দিলেন। তখন বেশ বেলা হইয়া গিয়াছিল। হযরত উসামা (রাঃ) আরোহণ করিয়া জুরুফ হইতে রওয়ানা হইতেছিলেন এমন সময় তাহার মাতা হযরত উম্মে আইমান (রাঃ)এর পক্ষ হইতে একজন সংবাদদাতা পৌঁছিয়া এই সংবাদ দিল যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়া হইতে বিদায় হইতেছেন। হযরত উসামা (রাঃ) সঙ্গে সঙ্গে মদীনার দিকে রওয়ানা হইলেন। তাহার সহিত হযরত ওমর (রাঃ) ও হযরত আবু ওবায়দাহ (রাঃ)ও ছিলেন। যখন তাহারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে পৌঁছিলেন তখন তাঁহার শেষ মুহূর্ত ছিল। বার রবিউল আউয়াল সোমবার দিন সূর্য ঢলার কাছাকাছি সময়ে তাঁহার ইন্তেকাল হইল। যে সকল মুসলমান জুরুফে (রওয়ানা হওয়ার জন্য প্রস্তুত হইয়া) অবস্থান করিতেছিলেন তাহারা সকলে মদীনায় ফিরিয়া আসিলেন। হযরত বুরাইদাহ ইবনে হুসাইব (রাঃ) হযরত উসামা (রাঃ) এর ঝাণ্ডা লইয়া আসিয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরজার সম্মুখে গাড়িয়া দিলেন।

অতঃপর যখন হযরত আবু বকর (রাঃ)এর বাইআত সম্পন্ন হইল তখন তিনি হযরত বুরাইদাহ (রাঃ) কে হুকুম দিলেন যেন উক্ত ঝাণ্ডা হযরত উসামা (রাঃ) এর ঘরে লইয়া যান এবং যতক্ষণ পর্যন্ত হযরত উসামা (রাঃ) মুসলমানদিগকে লইয়া জেহাদে চলিয়া না যান ততক্ষণ যেন ঝাণ্ডা না খোলেন। হযরত বুরাইদাহ (রাঃ) বলেন, আমি ঝাণ্ডা লইয়া হযরত উসামা (রাঃ) এর ঘরে গেলাম এবং তারপর সেই ঝাণ্ডা লইয়া হযরত উসামা (রাঃ) এর সহিত সিরিয়ায় গেলাম। পুনরায় সেই ঝাণ্ডা লইয়া (সিরিয়া হইতে) হযরত উসামা (রাঃ)এর ঘরে ফিরিয়া আসিলাম এবং সেই ঝাণ্ডা তাহার ইন্তেকাল পর্যন্ত তাহার ঘরেই তেমনি বাঁধা রহিল।

আরবগণ যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের সংবাদ পাইল এবং তাহাদের মধ্য হইতে যাহারা ইসলাম হইতে মুরতাদ হওয়ার হইয়া গেল তখন হযরত আবু বকর (রাঃ) হযরত উসামা (রাঃ)কে বলিলেন, তোমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেদিকে যাওয়ার হুকুম করিয়াছেন তুমি (আপন বাহিনী লইয়া) সেদিকে রওয়ানা হইয়া যাও। সুতরাং লোকজন পুনরায় (মদীনা হইতে) বাহির হইতে লাগিল এবং পূর্ববর্তী স্থানে সমবেত হইতে লাগিল ৷ হযরত বুরাইদাহ (রাঃ)ও ঝাণ্ডা লইয়া আসিলেন এবং পূর্বের ছাউনিতে পৌঁছিয়া গেলেন।

হযরত আবু বকর (রাঃ) কর্তৃক হযরত উসামা (রাঃ)এর এই বাহিনী প্রেরণের বিষয়টি বড় বড় মুহাজিরীনে আউয়ালীন সাহাবা (রাঃ)দের নিকট অত্যন্ত ভারি মনে হইল। অতএব হযরত ওমর, হযরত ওসমান, হযরত আবু ওবায়দাহ, হযরত সা’দ ইবনে আবি ওক্কাস ও হযরত সাঈদ ইবনে যায়েদ (রাঃ) হযরত আবু বকর (রাঃ) এর খেদমতে হাজির হইয়া আরজ করিলেন, হে আল্লাহর রাসূলের খলীফা, চারিদিকে আরবগণ আপনার আনুগত্য ছাড়িয়া দিয়াছে। এমতাবস্থায় আপনি এই বিস্তৃত  বিরাট বাহিনী পাঠাইয়া এবং (মদীনা হইতে) পৃথক করিয়া দিয়া কিছুই করিতে পারিবেন না। (আপনি এই বাহিনীকে এখানেই রাখুন।) তাহাদিগকে মুরতাদদের বিরুদ্ধে প্রস্তুত রাখুন এবং তাহাদের মোকাবেলায় পাঠান।

আর দ্বিতীয় কথা হইল, আমরা মদীনার উপর হঠাৎ কোন আক্রমণ হইয়া যাওয়ার আশংকা করিতেছি। অথচ এখানে (মুসলমানদের) মহিলা ও শিশুরা রহিয়াছে। এই মুহূর্তে আপনি রোমের উপর আক্রমণকে স্থগিত রাখুন। যখন ইসলাম তাহার পূর্বাবস্থার উপর মজবুত হইয়া যাইবে এবং মুরতাদরা হয় ইসলামে ফিরিয়া আসিবে—যেখান হইতে তাহারা বাহির হইয়া গিয়াছে অথবা তলোয়ার দ্বারা তাহারা চিরতরে শেষ হইয়া যাইবে। তারপর আপনি উসামা (রাঃ)কে রোমে প্রেরণ করুন। আমরা সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত যে, রুমীরা (এই মুহূর্তে) আমাদের দিকে (যুদ্ধের জন্য) অগ্রসর হইতেছে না। (অতএব তাহাদিগকে বাধা প্রদানের জন্য হযরত উসামা (রাঃ)এর বাহিনীকে এখন পাঠানোর কোন প্রয়োজন নাই।)

হযরত আবু বকর (রাঃ) যখন তাহাদের সমস্ত কথা শুনিয়া শেষ করিলেন তখন বলিলেন, তোমাদের মধ্য হইতে আর কেহ কিছু বলিতে চায় কি? তাহারা বলিলেন, না। আপনি আমাদের কথা সম্পূর্ণ শুনিয়াছেন। তিনি বলিলেন, সেই পাক যাতের কসম, যাহার হাতে আমার প্রাণ রহিয়াছে, যদি আমার এই দৃঢ় বিশ্বাসও হয় যে, (এই বাহিনী পাঠাইয়া দিলে) হিংস্র জন্তু আসিয়া আমাকে খাইয়া ফেলিবে তবুও আমি এই বাহিনীকে অবশ্যই প্রেরণ করিব (এবং খলীফা হওয়ার পর সর্বপ্রথম আমি এই কাজই করিতে চাই)। ইহার পূর্বে আর কোন কাজ করিতে চাই না। আর কিভাবে (এই বাহিনী রওয়ানা হইতে বাধা দেওয়া যাইতে পারে)?  অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর ওহী নাযিল হওয়া সত্ত্বেও তথাপি তিনি বলিতেছিলেন যে, উসামার বাহিনীকে রওয়ানা কর। অবশ্য একটি বিষয়ে আমি উসামার সহিত আলাপ করিতে চাই, আর তাহা এই যে, ওমর (না যাক এবং) আমাদের নিকট থাকিয়া যাক। কেননা তাহাকে ছাড়া আমাদের কাজ চলিবে না। আল্লাহ তায়ালার কসম, আমি জানিনা উসামা এরূপ করিবে কিনা। আল্লাহ তায়ালার কসম, সে যদি অস্বীকার করে তবে আমি তাহাকে বাধ্য করিব না। উপস্থিত লোকেরা বুঝিতে পারিলেন যে, হযরত আবু বকর (রাঃ) হযরত উসামা (রাঃ)এর বাহিনী প্রেরণের দৃঢ় সংকল্প করিয়াছেন।

হযরত আবু বকর (রাঃ) হাঁটিয়া হযরত উসামা (রাঃ) এর ঘরে গেলেন এবং হযরত ওমর (রাঃ)কে রাখিয়া যাওয়ার ব্যাপারে তাহার সহিত কথা বলিলেন। সুতরাং হযরত উসামা (রাঃ)ও সম্মত হইলেন। হযরত আবু বকর (রাঃ) তাহাকে বলিতে লাগিলেন যে, আপনি কি ওমর (রাঃ) কে এখানে থাকিয়া যাওয়ার ব্যাপারে) খুশীমনে অনুমতি দিয়াছ? হযরত উসামা (রাঃ) বলিলেন, জ্বি হাঁ। হযরত আবু বকর (রাঃ) বাহিরে আসিয়া নিজের ঘোষণাকারীকে এই ঘোষণা দেওয়ার হুকুম দিলেন যে, আমার পক্ষ হইতে এই বিষয়ে পূর্ণ তাকীদ করা হইতেছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় যে কেহ হযরত উসামা (রাঃ)এর বাহিনীতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হইয়াছিল সে যেন কোনক্রমেই এখন এই বাহিনী হইতে পিছনে থাকিয়া না যায়। (অবশ্যই যেন এই বাহিনীর সহিত যায়।) আর যদি আমার নিকট এরূপ কাহাকেও আনা হয় যে, সে এই বাহিনীতে যায় নাই তবে আমি অবশ্যই তাহাকে (শাস্তিস্বরূপ) পায়ে হাঁটাইয়া এই বাহিনীর সহিত শামিল করিব। আর ঐ সকল মুহাজিরীনদেরকে ডাকাইয়া আনাইলেন যাহারা হযরত উসামা (রাঃ)এর আমীর হওয়ার ব্যাপারে আপত্তি করিয়াছিলেন এবং তাহাদের সহিত কঠোর ব্যবহার করিলেন এবং তাহাদিগকে এই বাহিনীর সহিত যাইতে বাধ্য করিলেন। অতএব কেহই এই বাহিনীতে যোগদান হইতে পিছনে রহিল না। 

হযরত আবু বকর (রাঃ) হযরত উসামা (রাঃ) ও মুসলমানদেরকে বিদায় জানানোর জন্য বাহির হইয়া আসিলেন। এই বাহিনীর লোক সংখ্যা তিন হাজার ছিল। তার মধ্যে এক হাজার ঘোড়সওয়ার ছিল। হযরত উসামা (রাঃ) যখন নিজের সঙ্গীদের নিয়ে জুরুফ হইতে রওয়ানা হওয়ার জন্য সওয়ারীতে আরোহণ করিলেন, তখন হযরত আবু বকর (রাঃ) ও হযরত উসামা (রাঃ)এর পাশাপাশি কিছুদূর পর্যন্ত হাঁটিয়া গেলেন। অতঃপর (বিদায়ের) দোয়া

 

استودع الله دِينَكَ وَأَمَا نَتَكَ وَخَوَاتِيمَ عَمَلِكَ

পড়িলেন এবং বলিলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাকে (এই সফরের) হুকুম করিয়াছিলেন। অতএব তুমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশের কারণে যাও। আমি না তোমাকে এই কাজের আদেশ করিয়াছি, আর না তোমাকে উহা হইতে নিষেধ করিতেছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে কাজের আদেশ করিয়া গিয়াছেন আমি তো শুধু উহাকে কার্যকর করিতেছি।

অতঃপর হযরত উসামা (রাঃ) দ্রুতগতিতে রওয়ানা হইলেন এবং তিনি এমন এলাকার উপর দিয়া অতিক্রম করিলেন যেখানে শান্তি বিরাজ করিতেছিল এবং সেখানকার লোকেরা মোরতাদ হয় নাই। যেমন কুসাআর জুহাইনা ও অন্যান্য গোত্রসমূহ। হযরত উসামা (রাঃ) যখন ওয়াদী কোরা’তে পৌঁছিলেন তখন তিনি বনু উযরার হুরাইস নামী এক ব্যক্তিকে গুপ্তচর হিসাবে সম্মুখে পাঠাইলেন। সে নিজের বাহনে চড়িয়া হযরত উসামা (রাঃ)এর পূর্বে রওয়ানা হইল এবং চলিতে চলিতে সে একেবারে উবনা পর্যন্ত পৌঁছিয়া গেল। সে সেখানকার অবস্থা ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করিয়া বাহিনীর জন্য উপযুক্ত রাস্তাও তালাশ করিল। অতঃপর দ্রুত ফিরিয়া আসিল এবং উবনা হইতে দুই রাত্র পরিমাণ সফরের দূরত্বে আসিয়া হযরত উসামা (রাঃ)এর সহিত মিলিত হইল এবং এই সংবাদ জানাইল যে, লোকজন সম্পূর্ণ গাফেল অবস্থায় আছে। (তাহারা মুসলিম বাহিনীর আগমন সম্পর্কে কিছুই জানে না।) তাহাদের সম্মিলিত কোন বাহিনীও নাই। আর সে পরামর্শ দিল যে, বাহিনী লইয়া দ্রুতগতিতে চলুন, যাহাতে তাহাদের সৈন্য সমবেত হওয়ার পূর্বে বিভিন্ন দিক হইতে তাহাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ করা যায়।

হযরত হাসান ইবনে আবিল হাসান (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তেকালের পূর্বে মদীনাবাসী ও আশেপাশের লোকদের সমন্বয়ে একটি বাহিনী প্রস্তুত করিলেন। উক্ত বাহিনীতে হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ)ও ছিলেন। হযরত উসামা ইবনে যায়েদ (রাঃ)কে এই বাহিনীর আমীর নিযুক্ত করিলেন । এই বাহিনীর শেষাংশ খন্দক অতিক্রম করার পূর্বেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকাল হইয়া গেল। হযরত উসামা (রাঃ) লোকদের সহ থামিয়া গেলেন এবং হযরত ওমর (রাঃ)কে বলিলেন, আপনি ফেরৎ যাইয়া আল্লাহর রসূলের খলীফার নিকট (আমাদের জন্য ফেরৎ যাওয়ার) অনুমতি গ্রহণ করুন। তিনি যেন আমাকে অনুমতি দেন যাহাতে আমরা সকলে মদীনায় ফিরিয়া যাই। কেননা আমার সহিত বাহিনীতে বড় বড় সাহাবায়ে কেরাম রহিয়াছেন। আমার আশংকা হইতেছে, মুশরিকগণ আল্লাহর রাসূলের খলীফা ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিবার পরিজন ও মুসলমানদের পরিবার পরিজনের উপর অতর্কিতে আক্রমণ করিয়া না দেয়।হায়াতুস সাহাবা

 

আনসারগণ বলিলেন, যদি হযরত আবু বকর (রাঃ) আমাদের ব্যাপারে সম্মুখে যাওয়ারই ফয়সালা করেন তবে তাঁহাকে আমাদের পক্ষ হইতে এই পয়গাম দিয়া দাবী জানাইবেন যে, তিনি যেন এমন কাহাকেও আমাদের আমীর বানাইয়া দেন যিনি হযরত উসামা (রাঃ) হইতে বয়স্ক হন। হযরত ওমর (রাঃ) হযরত উসামা (রাঃ ) এর পয়গাম লইয়া গেলেন এবং হযরত আবু বকর (রাঃ)কে হযরত উসামা (রাঃ) এর পয়গাম সম্পর্কে অবহিত করিলেন। হযরত আবু বকর (রাঃ) বলিলেন, যদি কুকুর ও চিতা আমাকে টানিয়া লইয়া যায় (এবং আমাকে ছিঁড়িয়া ছিড়িয়া খাইয়া ফেলে) তবুও আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ফয়সালাকে ফেরৎ লইতে পারি না। অতঃপর হযরত ওমর (রাঃ) বলিলেন, আমাকে আনসারগণ বলিয়াছিলেন যে, তাঁহাদের এই পয়গাম | আপনার নিকট পৌঁছাইয়া দেই যে, তাহাদের ইচ্ছা হইল, আপনি এমন লোককে তাহাদের আমীর বানাইয়া দিন যিনি হযরত উসামা (রাঃ ) অপেক্ষা বয়স্ক হন।

হযরত আবু বকর (রাঃ) বসিয়াছিলেন। এই কথা শুনিয়া তিনি লাফাইয়া উঠিলেন এবং হযরত ওমর (রাঃ)এর দাড়ি ধরিয়া বলিলেন, হে ইবনে খাত্তাব! তোমার মা তোমাকে হারাক, (অর্থাৎ, তুমি মরিয়া যাও) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাহাকে আমীর বানাইয়াছেন, আর তুমি আমাকে বলিতেছ যে, আমি তাহাকে আমীরের পদ হইতে সরাইয়া দেই। হযরত ওমর (রাঃ) সেখান হইতে বাহির হইয়া লোকদের নিকট আসিলেন। লোকেরা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, কি করিয়া আসিলেন? হযরত ওমর (রাঃ) বলিলেন, তোমরা সফর আরম্ভ কর। তোমাদের মাতাগণ তোমাদেরকে হারাক! আজ তোমাদের কারণে আমাকে আল্লাহর রাসূলের খলীফার পক্ষ হইতে অনেক কিছু সহ্য করিতে হইয়াছে। অতঃপর স্বয়ং হযরত আবু বকর (রাঃ) তাহাদের নিকট আসিলেন এবং তাহাদেরকে খুব উৎসাহ দিলেন। তিনি তাহাদিগকে এইভাবে বিদায় দিলেন যে, স্বয়ং তাহাদের সহিত পায়দল চলিতেছিলেন এবং হযরত উসামা (রাঃ) সওয়ারীতে আরোহী ছিলেন। হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রাঃ) হযরত আবু বকর (রাঃ)এর সওয়ারীর লাগাম টানিয়া চলিতেছিলেন। হযরত উসামা (রাঃ) বলিলেন, হে আল্লাহর রাসূলের খলীফা! হয় আপনি সওয়ার হইয়া যান, আর না হয় আমি নিচে নামিয়া পায়দল চলি। হযরত আবু বকর (রাঃ) বলিলেন, আল্লাহর কসম, না তুমি নামিবে, আর আল্লাহর কসম, না আমি চড়িব। ইহাতে কি ক্ষতি যে, আমি কিছুক্ষণ আল্লাহর রাস্তায় আমার পা দ্বয়কে ধুলিযুক্ত করি। কারণ গাজী যে কোন কদম উঠায়, তাহার প্রতি কদমে সাতশত নেকী লেখা হয়, তাহার সাতশত মর্তবা উন্নত করা হয় এবং তাহার সাতশত গুনাহ মিটাইয়া দেওয়া হয়।

হযরত আবু বকর (রাঃ) যখন বিদায় দিয়া ফিরিতে লাগিলেন তখন তিনি হযরত উসামা (রাঃ)কে বলিলেন, যদি তুমি ভাল মনে কর তবে ওমরকে আমার সাহায্যের জন্য এখানে রাখিয়া যাও। সুতরাং হযরত উসামা (রাঃ) হযরত ওমর (রাঃ)কে মদীনায় হযরত আবু বকর (রাঃ) এর নিকট থাকিয়া যাওয়ার অনুমতি দিলেন। (মুখতাসার ইবনে আসাকির)

হযরত ওরওয়া (রাঃ) বলেন, সাহাবা (রাঃ) যখন (হযরত আবু বকর (রাঃ)এর) বাইয়াত হইতে অবসর হইলেন এবং লোকেরা সকলে শান্ত হইল তখন হযরত আবু বকর (রাঃ) হযরত উসামা (রাঃ)কে বলিলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাকে যেখানে যাইতে হুকুম করিয়াছিলেন তুমি সেখানকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হইয়া যাও । মুহাজিরীন ও আনসারদের মধ্য হইতে কিছু লোক হযরত হযরত আবু বকর (রাঃ)এর সহিত কথা বলিলেন। তাহারা বলিলেন, আপনি হযরত উসামা (রাঃ) ও তাহার বাহিনীকে (না পাঠাইয়া) রুখিয়া দিন। কেননা আমাদের আশংকা হইতেছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের খবর শুনিয়া সমস্ত আরব আমাদের উপর আক্রমণ করিয়া বসিবে।

হযরত আবু বকর (রাঃ) যিনি সর্বাপেক্ষা বিচক্ষণ ও মজবুত ছিলেন— তিনি বলিলেন, আমি সেই বাহিনীকে রুখিয়া দিব যাহাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রওয়ানা করিয়াছেন? তবে তো ইহা আমার বিরাট দুঃসাহসিকতা প্রদর্শন হইবে। সেই পবিত্র যাতের কসম, যাহার হাতে আমার প্রাণ রহিয়াছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রেরিত বাহিনীকে আমি রুখিয়া দেই ইহা অপেক্ষা আমার নিকট অধিক প্রিয় এই যে, আমার উপর সমগ্র আরব আক্রমণ করিয়া বসে। হে উসামা, তুমি তোমার বাহিনী লইয়া সেখানে যাও যেখানে যাওয়ার তোমাকে হুকুম দেওয়া হইয়াছে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাকে ফিলিস্তীনের যে এলাকায় যাইয়া যুদ্ধ করিতে হুকুম করিয়াছিলেন তুমি সেখানে যাইয়া মুতাবাসীদের সহিত যুদ্ধ কর। তুমি এখানে যাহাদিগকে ছাড়িয়া যাইতেছ তাহাদের জন্য আল্লাহ যথেষ্ট। অবশ্য তুমি যদি ভাল মনে কর তবে ওমরকে এখানে থাকিয়া যাওয়ার অনুমতি দাও। আমি তাহার সহিত পরামর্শ করিব এবং তাহার সাহায্য গ্রহণ করিব। কেননা তাহার রায় অতি উত্তম এবং সে ইসলামের অত্যন্ত হিতাকাংখী। অতএব হযরত উসামা (রাঃ) অনুমতি দিলেন ।

অধিকাংশ আরব ও পূর্বাঞ্চলীয় লোকেরা ইসলাম হইতে ফিরিয়া গিয়াছিল। এমনিভাবে গাতফান, বনু আসাদ গোত্রদ্বয় ও আশজা গোত্রের অধিকাংশ লোক ইসলাম হইতে ফিরিয়া গিয়াছিল। অবশ্য বনু তাই গোত্র ইসলামকে ধরিয়া রাখিয়াছিল। অধিকাংশ সাহাবা (রাঃ) হযরত আবু বকর (রাঃ)কে বলিলেন, হযরত উসামা (রাঃ) ও তাহার বাহিনীকে নিষেধ করিয়া দিন এবং তাহাদিগকে গাতফান ও অবশিষ্ট আরব যাহারা ইসলাম হইতে মোরতাদ হইয়া গিয়াছে তাহাদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করুন। কিন্তু হযরত আবু বকর (রাঃ) হযরত উসামা (রাঃ) ও তাহার বাহিনীকে রুখিতে অস্বীকার করিলেন এবং বলিলেন, তোমাদের জানা আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগ হইতে এই নিয়ম চলিয়া আসিতেছে যে, যে সমস্ত বিষয়ে তোমাদের নবীর পক্ষ হইতে কোন সুন্নাত জানা না থাকে বা কোরআনে কোন পরিষ্কার হুকুম তোমাদের উপর নাযিল না হইয়া থাকে কেবল সেই সমস্ত বিষয়ে আমরা পরামর্শ করিয়া থাকি। তোমরা তোমাদের পরামর্শ দিয়াছ, এখন আমি তোমাদিগকে পরামর্শ দিতেছি, উভয়ের মধ্যে যাহা তোমাদের নিকট উত্তম মনে হয় উহাকে অবলম্বন কর। কারণ আল্লাহ তায়ালা কখনও তোমাদিগকে কোন গোমরাহীর উপর ঐক্যমত করিবেন না। সেই পাক যাতের কসম, যাহার হাতে আমার প্রাণ, আমার মতে সর্বাপেক্ষা উত্তম পন্থা এই যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাহার নিকট হইতে যাকাতের জানোয়ারের সহিত রশি লইতেন সে সেই রশি দিতে অস্বীকার করিলেও তাহার সহিত জেহাদ করা হউক। সমস্ত মুসলমান হযরত আবু বকর (রাঃ)এর রায়কে মানিয়া লইলেন এবং সকলেই বুঝিতে পারিলেন যে, হযরত আবু বকর (রাঃ)এর রায় তাহাদের রায় অপেক্ষা উত্তম। অতএব হযরত আবু বকর (রাঃ) হযরত উসামা ইবনে যায়েদ (রাঃ)কে সেখানে পাঠাইয়া দিলেন যেখানে যাওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাহাকে হুকুম দিয়াছিলেন।

এই জেহাদের ব্যাপারে হযরত আবু বকর (রাঃ) সঠিক ফয়সালা করিয়াছিলেন। আল্লাহ তায়ালা হযরত উসামা (রাঃ) ও তাহার বাহিনীকে প্রচুর গনীমতের মাল দান করিলেন এবং তাহাদিগকে নিরাপদে ফিরাইয়া আনিলেন। হযরত উসামা (রাঃ) রওয়ানা হওয়ার পর হযরত আবু বকর (রাঃ) মুহাজিরীন ও আনসারদের এক জামাত লইয়া (মুরতাদদের মুকাবিলার জন্য) বাহির হইলেন। গ্রাম্য আরবরা তাহাদের সন্তানসন্ততি লইয়া পালাইয়া গেল। মুসলমানগণ যখন জানিতে পারিলেন যে, সমস্ত গ্রাম্য আরব তাহাদের সন্তানসন্ততি লইয়া পালাইয়া গিয়াছে তখন তাহারা হযরত আবু বকর (রাঃ) এর সহিত কথা বলিলেন। তাহারা বলিলেন, এখন আপনি মদীনায় মহিলা ও শিশুদের নিকট ফিরিয়া যান এবং আপনার সঙ্গীদের মধ্য হইতে কাহাকেও জামাতের আমীর নিযুক্ত করিয়া আপনার দায়িত্ব তাহাকে অর্পণ করিয়া দিন। মুসলমানগণ হযরত আবু বকর (রাঃ)কে এই ব্যাপারে বুঝাইতে থাকিলেন। অবশেষে হযরত আবু বকর (রাঃ) মদীনায় ফিরিয়া যাইতে সম্মত হইলেন এবং হযরত খালেদ ইবনে ওলীদ (রাঃ)কে আমীর বানাইয়া দিলেন। তিনি হযরত খালেদ (রাঃ)কে বলিলেন, আরবের লোকেরা যখন মুসলমান হইয়া যাইবে এবং যাকাত দিতে আরম্ভ করিবে তখন তোমাদের মধ্য হইতে যে কেহ ফিরিয়া আসিতে চাহিবে সে ফিরিয়া আসিবে। অতঃপর হযরত আবু বকর (রাঃ) মদীনায় ফিরিয়া আসিলেন। (কান্ য)

ওরওয়া (রাঃ) বলেন, হযরত আবু বকর (রাঃ)এর বাইআত সম্পন্ন হওয়ার পর যখন আনসারগণ খেলাফতের বিষয়ে সকলেই একমত হইয়া গেলেন তখন হযরত আবু বকর (রাঃ) বলিলেন, হযরত উসামা (রাঃ) এর বাহিনীর (রওয়ানা হওয়ার) কাজ সম্পন্ন হওয়া উচিত। আরবের পরিস্থিতি এই ছিল যে, লোকেরা মোরতাদ হইয়া গেল। কোন কোন গোত্র তো সম্পূর্ণই, আর কোন কোন গোত্রের কিছু কিছু লোক মোরতাদ হইয়া গেল এবং মোনাফেকী প্রকাশ হইয়া পড়িল, আর ইহুদীবাদ ও খৃষ্টবাদ মাথা উত্তোলন করিয়া দেখিতে লাগিল। আর যেহেতু মুসলমানদের নবীর ইন্তেকাল হইয়া গিয়াছিল, তদুপরি তাহাদের সংখ্যা ছিল কম আর তাহাদের শত্রু সংখ্যা ছিল অধিক সেহেতু মুসলমানদের অবস্থা শীতের রাত্রে বৃষ্টিভেজা বকরীর পালের মত ছিল।

এমতাবস্থায় লোকেরা হযরত আবু বকর (রাঃ) কে বলিল, এই যৎসামান্য মুসলমান। আর আপনি দেখিতেছেন যে, আরবগণ আপনার অবাধ্য হইয়া গিয়াছে। অতএব আপনার জন্য সমুচিত নয় যে, এরূপ অবস্থায় মুসলমানদের এই জামাত (অর্থাৎ হযরত উসামা (রাঃ) এর বাহিনী)কে আপনার নিকট হইতে পৃথক করিয়া পাঠাইয়া দেন। ইহার জবাবে হযরত আবু বকর (রাঃ) বলিলেন, সেই পবিত্র যাতের কসম যাহার হাতে আবু বকরের প্রাণ রহিয়াছে, যদি আমার দৃঢ় বিশ্বাস হইয়া যায় যে, আমাকে হিংস্র জন্তু উঠাইয়া লইয়া যাইবে তবুও আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হুকুম অনুযায়ী উসামার বাহিনীকে অবশ্যই রওয়ানা করিব। যদি জনবসতিতে আমি ব্যতীত আর কেহ অবশিষ্ট না থাকে তবুও আমি এই বাহিনীকে অবশ্যই রওয়ানা করিয়া ছাড়িব ।

হযরত আসেম ও হযরত আমরাহ (রহঃ) বর্ণনা করেন যে, হযরত আয়েশা (রাঃ) বলিয়াছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইত্তেকালের পর সমস্ত আরব মোরতাদ হইয়া গেল এবং নেফাক (মোনাফেকী) মাথা উঠাইয়া দেখিতে লাগিল। আল্লাহর কসম, আমার পিতার উপর তখন এমন মুসীবত আসিয়া পড়িয়াছিল যে, যদি উহা মজবুত পাহাড়সমূহের উপর পড়িত তবে পাহাড়কেও চূর্ণবিচূর্ণ করিয়া দিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবাদের অবস্থা তখন এমন হইয়া গিয়াছিল যেমন অন্ধকার রাত্রে হিংস্র জন্তু ভরা এলাকায় বৃষ্টিভেজা ভীত সন্ত্রস্ত বকরীর হইয়া থাকে। আল্লাহর কসম, সেই সময় সাহাবাদের মধ্যে যে কোন বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিত আমার পিতা উহার অনিষ্টকে দূর করিতেন এবং উহার লাগাম ধরিয়া উপযুক্ত ফয়সালা করিয়া দিতেন। (যদ্দরুন বিরোধ শেষ হইয়া যাইত।)

হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বলেন, আল্লাহর কসম, যিনি ব্যতীত কোন মাবুদ নাই, যদি (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর) হযরত আবু বকর (রাঃ) খলীফা নিযুক্ত না হইতেন তবে (দুনিয়াতে আল্লাহ তায়ালার এবাদত হইত না। হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) দ্বিতীয় বার এই কথা বলিলেন। তারপর তৃতীয়বার বলিলেন। লোকেরা তাহাকে বলিল, হে আবু হোরায়রা, আপনি এমন কথা হইতে বিরত হউন। তিনি বলিলেন, (আমি এই কথা এইজন্য বলিতেছি যে,) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাতশতজনের এক বাহিনী দিয়া হযরত উসামা ইবনে যায়েদ (রাঃ)কে সিরিয়ায় প্রেরণ করিয়াছিলেন। ( প্রসিদ্ধ রেওয়ায়াত অনুসারে এই বাহিনীর লোকসংখ্যা তিন হাজার ছিল। তন্মধ্যে কোরাইশদের সংখ্যা সম্ভবতঃ সাতশত ছিল বলিয়া এই রেওয়ায়াতে সাতশত উল্লেখ করিয়াছেন।)

হযরত উসামা (রাঃ) যখন ‘যি-খুশুব’ নামক স্থান পর্যন্ত পৌঁছিলেন তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকাল হইয়া গেল এবং মদীনার আশে পাশের আরবগণ মোরতাদ হইয়া গেল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণ হযরত আবু বকর (রাঃ) এর নিকট সমবেত হইয়া বলিলেন, হে আবু বকর! এই বাহিনীকে ফেরৎ লইয়া আসুন। আপনি এই বাহিনীকে রোম পাঠাইতেছেন অথচ মদীনার আশেপাশের আরবগণ মোরতাদ হইয়া গিয়াছে? হযরত আবু বকর (রাঃ) বলিলেন, সেই পাক যাতের কসম, যিনি ব্যতীত কোন মা’বুদ নাই, যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্মানিতা বিবিদের পা কুকুরে টানিয়া বেড়ায় তবুও আমি সেই বাহিনীকে ফেরৎ আনিব না যাহাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রওয়ানা করিয়াছেন এবং আমি সেই ঝাণ্ডা খুলিতে পারিব না যাহা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাঁধিয়াছেন। সুতরাং হযরত আবু বকর (রাঃ) হযরত উসামা (রাঃ)এর বাহিনীকে (ফেরৎ না আনিয়া) রওয়ানা করিয়া দিলেন। ফলে এই বাহিনী যে কোন এমন গোত্রের নিকট দিয়া অতিক্রম করিল যাহারা মোরতাদ হওয়ার ইচ্ছা করিয়াছিল তাহারা বলাবলি করিতে লাগিল যে, মুসলমানদের নিকট যদি বিরাট শক্তি না থাকিত তবে তাহাদের নিকট হইতে এত বড় বাহিনী বাহির হইত না। আমরা এখন মুসলমানদেরকে কিছু বলিব না। তাহাদেরকে রুমীদের সহিত যুদ্ধ করিতে দাও। তারপর দেখিব। সুতরাং এই বাহিনী রুমীদের সহিত যুদ্ধ করিল এবং তাহাদিগকে পরাজিত করিয়া, কতল করিয়া সহীসালামতে ফিরিয়া আসিল। এইভাবে পথিমধ্যের সমস্ত আরব গোত্রগুলি ইসলামের উপর মজবুত হইয়া গেল। (বিদায়াহ)

 

হায়াতুস্ সাহাবাহ্ (রাঃ)
২য় খন্ড, পৃষ্ঠা: ৪৭-৬২

হায়াতুস্ সাহাবাহ্ (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) আরো পড়তে ক্লিক করুন

 

 

jobedubd3415 Avatar

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *